মানুষ হলো আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির সেরা নিদর্শন। আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ)-এর মাধ্যমে মানবজাতির সূচনা, এবং সেই সূত্রে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ পরস্পরের আত্মীয়—ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। ইসলাম শুধু আত্মিক ইবাদতের ধর্ম নয়; বরং এটি মানবিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার ও পারস্পরিক সম্মানের পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় কাউকে কষ্ট দেওয়া, অপমান করা বা হেয় প্রতিপন্ন করার কোনো সুযোগ নেই।
মানুষে মানুষে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণগুলোর একটি হলো অসচেতনভাবে অন্যকে কষ্ট দেওয়া। অনেক সময় আমরা বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিই না, অথচ ইসলামি দৃষ্টিতে এটি গুরুতর অপরাধ এবং এর পার্থিব ও পরকালীন ফলাফল ভয়াবহ।
ইসলামে মানুষকে কষ্ট দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা
ইসলাম মানুষের সম্মান ও মর্যাদাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। বিশেষ করে একজন মুসলমান আরেক মুসলমানের জন্য ভাই। এই ভ্রাতৃত্ব কেবল মুখে উচ্চারণের বিষয় নয়; বরং এটি দায়িত্ব, সহানুভূতি ও আত্মসংযমের শিক্ষা দেয়। কাউকে অকারণে মানসিক বা শারীরিক কষ্ট দেওয়া স্পষ্টভাবে হারাম।
রাসূলুল্লাহ ﷺ মুসলমানদের সতর্ক করে বলেছেন—যে ব্যক্তি অন্যের দোষ খোঁজে, আল্লাহ তার দোষ প্রকাশ করে দেন। অর্থাৎ মানুষকে কষ্ট দেওয়া শেষ পর্যন্ত নিজের জন্যই লাঞ্ছনা ও বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মানুষকে কষ্ট দেওয়ার প্রধান মাধ্যম
সাধারণভাবে মানুষ দু’ভাবে অন্যকে কষ্ট দেয়—
১) কথা দ্বারা
২) কাজ দ্বারা
কাজের মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া সহজেই দৃশ্যমান হয়। কিন্তু কথার মাধ্যমে করা কষ্ট অনেক সময় দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়, অথচ এর ক্ষত সবচেয়ে গভীর হয়।
১. কথার আঘাত: সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্র
শারীরিক আঘাতের ক্ষত একসময় সেরে যায়, কিন্তু কটু কথা, অপমানজনক মন্তব্য বা তাচ্ছিল্যের স্মৃতি দীর্ঘদিন মানুষের অন্তরে দগদগে থেকে যায়। তাই ইসলাম ভাষার সংযমের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে।
কথার মাধ্যমে কষ্ট দেওয়ার কয়েকটি বহুল প্রচলিত রূপ হলো—
ক) গালি ও অশ্লীল ভাষা
গালিগালাজ শুধু একজন মানুষকেই ছোট করে না; বরং যে গালি দেয়, সে নিজের চরিত্র ও আমলকেই ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। পরকালে এই গুনাহের বদলা দিতে হবে নিজের নেক আমল দিয়ে। যার নেক আমল শেষ হয়ে যাবে, সে নিঃস্ব অবস্থায় জাহান্নামের মুখোমুখি হবে—এটাই ইসলামের স্পষ্ট সতর্কবার্তা।
খ) গীবত ও অপবাদ
কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ আলোচনা করা—সে দোষ সত্য হলেও—গীবত। আর মিথ্যা দোষ চেপে দেওয়া হলো অপবাদ। এই দুই অপরাধ সমাজে বিভেদ, সন্দেহ ও শত্রুতা সৃষ্টি করে। মানুষ প্রায়ই এটিকে “সত্য কথা বলা” ভেবে হালকা করে নেয়, অথচ কুরআনের ভাষায় এটি মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণের সমতুল্য।
গ) চোগলখুরি
একজনের কথা আরেকজনের কাছে লাগিয়ে দেওয়া, সম্পর্ক নষ্ট করার উদ্দেশ্যে তথ্য বিকৃত করা—এটাই চোগলখুরি। ইসলামি দৃষ্টিতে এটি নিকৃষ্ট চরিত্রের লক্ষণ। এমন ব্যক্তি সমাজে শান্তি নয়, আগুন লাগিয়ে বেড়ায়। রাসূল ﷺ স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন—চোগলখুরির কারণে কবরেও শাস্তি হতে পারে।
ঘ) মন্দ নামে ডাকা
মানুষের দুর্বলতা বা অতীতকে ধরে কটাক্ষমূলক নাম দেওয়া তাকে মানসিকভাবে ভেঙে দেয়। ঈমান আনার পরও এমন আচরণ করা ফাসেকির শামিল। ইসলাম মানুষের পরিচয়, সম্মান ও অনুভূতির প্রতি পূর্ণ মর্যাদা দিতে শেখায়।
ঙ) উপহাস ও তুচ্ছজ্ঞান
কে ভালো, কে মন্দ—এর চূড়ান্ত বিচার আল্লাহ ছাড়া কেউ করতে পারে না। কাউকে সামাজিক অবস্থান, শারীরিক গঠন বা সামান্য দুর্বলতার কারণে উপহাস করা অহংকারের বহিঃপ্রকাশ। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি বড় অপরাধ, কারণ তাকওয়া বাহ্যিক নয়—অন্তরের বিষয়।
দুনিয়া ও আখিরাতে পরিণতি
মানুষকে কষ্ট দেওয়ার শাস্তি শুধু পরকালের জন্য সংরক্ষিত নয়। এতে দুনিয়াতেও সম্পর্ক ভাঙে, বিশ্বাস নষ্ট হয়, সমাজ অশান্ত হয়ে ওঠে। আর আখিরাতে—
নেক আমল দিয়ে ক্ষতিপূরণ
অন্যের গুনাহ নিজের কাঁধে চাপা
এমনকি জাহান্নামের শাস্তি
এই সবকিছুই অপেক্ষা করে তাদের জন্য, যারা মানুষের সম্মান নিয়ে খেলাধুলা করে।
উপসংহার
ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে—প্রকৃত মুসলমান সে নয়, যে শুধু নামাজ পড়ে বা রোজা রাখে; বরং সে, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মানুষ নিরাপদ থাকে। মানুষের হৃদয় ভাঙা কাবা ভাঙার চাইতেও ভয়াবহ অপরাধ—এই চেতনা হৃদয়ে লালন করাই ঈমানের দাবি।
অতএব, কথা বলার আগে ভেবে বলা, দোষ ঢেকে রাখা, অহংকার পরিহার করা এবং মানুষকে সম্মান করা—এই গুণগুলোই একটি সুন্দর সমাজ ও নিরাপদ পরকালের চাবিকাঠি।
আরও পড়ুন: এক অস্থির জেনারেশন তৈরী করছি আমরা



